জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সকল শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করায় আবারো সেশনজটের কবলে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এই পরিস্থিতিতে ঠিক কবে থেকে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এ কারণে শিক্ষাজীবন নিয়ে চিন্তিতো হয়ে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী। আবার কবে তারা শিক্ষার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন তা বলতে পারছেন না কেউই। এদিকে আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবিরের দায়িত্বকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রায় সেশনজটমুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাস থেকে এক বছরের সেশনজটের সৃষ্টি হয়েছে।
২০১২ সালে টানা সাড়ে তিন মাস ধরে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনে অধিকাংশ সময় স্থবিরতা বিরাজ করেছিল ক্যাম্পাসে। পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর শিক্ষাকার্যক্রম শুরু স্বাভাবিকভাবে শুরু হলেও রয়ে যায় দীর্ঘ সময়ের সেশনজট। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম আবর্তনের (২০১২-১৩ সেশন) শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সে থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ বিভাগে মাস্টার্সে রয়েছেন ৪১তম আবর্তন শিক্ষার্থীরাই (২০১১-১২ সেশন)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের আওতাভূক্ত ৩৪টি বিভাগ ও দুটি ইন্সটিটিউটের মধ্যে আইবিএ, বাংলা বিভাগ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগে সেশনজট না থাকলেও অধিকাংশ বিভাগেই ছয় মাস থেকে এক বছরের সেশনজট রয়েছে। এর মধ্যে, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, অর্থনীতি, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা, ইতিহাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সেশনজট প্রায় এক বছরেরও বেশি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসের প্রথম দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী, ইতিহাস, জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ, চারুকলা, প্রত্নতত্ত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রসায়ন, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, ফার্মেসি, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিস্ক, পরিসংখ্যান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। পূর্বনির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী ঈদ-উল-ফিতরের ছুটির আগেই পরীক্ষার শেষ হওয়ার কথা ছিলো বিভিন্ন বিভাগের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী জানান, সেশনজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতেও অধিকাংশ বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অনির্দিষ্টকালীন ছুটি ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস ও পরীক্ষাসমূহও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এতে করে সেশনজটের আশঙ্কা আরো বেড়ে গেলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শিহাব শাহরিয়ার বলেন, ‘প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সাথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়েরও ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয় । কিšু‘ নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন মাস পর। এখন আবার হঠাৎ হল ভ্যাকেন্ট! প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন একটা সময় হল ভ্যাকেন্টের সিদ্ধান্ত আসলো যখন বেশ কয়েকটা বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা চলে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষার্থী মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের চেয়ার রক্ষায় শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলেন। আন্দোলন বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে হল ভ্যাকেন্টের এই সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যলয়গুলোকে প্রতিযোগিতার বিশ্বে পিছিয়ে দিচ্ছে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৬ মাসের দীর্ঘ সেশনজট ছিল, হঠাৎ ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করায় এখন সেশনজট আরও বেড়ে যাবে। গত শনিবার জরুরি সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকায় আমি উপস্থিত ছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে বসে যে সিন্ধান্ত নিবেন সে সিদ্ধান্তই আমরা মেনে নিবো।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, “ছাত্র-ছাত্রীদের সাময়িক ভোগান্তির জন্য আমরা দুঃখিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালীন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট মোকাবেলার পর একাডেমিক সিন্ধান্তের মাধ্যমে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
উল্লেখ্য, গত ২৭ মে রাতে উপাচার্যের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের জরুরি সভার সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ২৮ মে সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় না খোলা পর্যন্ত সকল প্রকার ক্লাস এবং পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।