রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) বৈদ্যুতিক বাল্ব সরবরাহ, ফিটিং, ফিক্সিং ও বৈদ্যুতিক খুঁটি সরবরাহ এবং ওভারহেড লাইন স্থাপন কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কারসাজি করে কাজ দিয়েছে ঢাকার তেজতুরি বাজারের এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। বৈদ্যুতিক ঠিকাদারি লাইসেন্স ছাড়াই ২০১৬ সালের ১২ মে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর এক কোটি ৯৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকার তিনটি দরপত্রে কার্যাদেশ পায় প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে নিম্নমানের এলইডি বাল্ব সরবরাহ করে ফিটিং ও ফিক্সিং এবং নিম্নমানের বৈদ্যুতিক খুঁটি সরবরাহ ও চোরাই তারে ওভারহেড লাইন স্থাপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও এলইডি বাল্ব সরবরাহ, ফিটিং ও ফিক্সিংয়ের আরেকটি কাজ করতে পারেনি এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং। তারপরও প্রতিষ্ঠানটিকে বিল দিয়েছে রাসিক। কালো তালিকাভুক্ত না করেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ। এ তিনটি দরপত্রেরই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ছিলেন রাসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) রেয়াজাত হোসেন। তার ইন্ধনেই এসব অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১২ মে ১৫ ওয়াটের ১০ হাজার ও ৩২ ওয়াটের ১১ হাজার এলইডি বাল্ব সরবরাহের কার্যাদেশ পায় এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং। চতুর্থ সর্বনিম্ন হিসেবে ৮৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা দর দিয়েও কাজ পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিলো হ্যারো ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন। কাগজপত্রের ত্রুটি দেখিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয় টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি। ওই কার্যাদেশের বিপরীতে এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং নিম্নমানের এলইডি বাল্ব সরবরাহ করে। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) কারিগরি কমিটির পরীক্ষায় ধরা পড়ে এসব ত্রুটি।
রুয়েটের পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, সরবরাহকৃত বাল্বগুলোর ওয়াট বেশি। এ ছাড়া পানি নিরোধ ক্ষমতাও কম। যা দরপত্রে উল্লেখ নমুনার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তারপরও প্রতিষ্ঠানটিকে বিল পরিশোধ করে রাসিক।ওই বছরেরই ২৬ সেপ্টেম্বর একই প্রক্রিয়ায় এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিংকে ৯ মিটারের ২৬টি এবং ১২ মিটারের ২৮টি জিআই পোল সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায় কাজটি পায় প্রতিষ্ঠানটি। নগরীর সাগরপাড়া থেকে রাণীবাজার পর্যন্ত পোল স্থাপন ছাড়াও কথা ছিল ওভারহেড লাইন স্থাপনের।
কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিআই পোলের পরিবর্তে এমএস পোল স্থাপন করে। জানতে পেরে নর্থওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জিআই পোল পুনঃস্থাপনে চিঠি দেয় রাসিককে। পরে রুয়েটে নমুনা পরীক্ষাতেও ধরা পড়ে বিষয়টি। সেই সময় ত্রুটিপূর্ণ পোল সরিয়ে শর্তানুযায়ী পোল সরবরাহে এসএলকে ইনঞ্জিনিয়ারিংকে চিঠি দেয় রাসিক।
তবে ওই পোল পুনঃস্থাপনে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে বলে পরে এসএলকে ইনঞ্জিনিয়ারিং আবেদন করে। শেষ পর্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ পোল না সরিয়েই বিল পরিশোধ করা হয় ঠিকাদারকে। এ ছাড়া সঞ্চালন লাইনে লাগানো হয় পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) সিল মোহরকৃত বৈদ্যুতিক তার ও ফিটিংস। এগুলো চোরাই বলে জানিয়েছেন নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র।
এদিকে ২০১৬ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর ৬০ লাখ ৭৪ হাজার টাকার এলইডি বাল্ব সরবরাহের আরো একটি কার্যাদেশ পায় এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং। সেবার তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল প্রতিষ্ঠানটি। শর্তানুযায়ী, ১৫ ওয়াটের ৮ হাজার এবং ৩২ ওয়াটের ৫০০ বাল্ব সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু ধাপে ধাপে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়িয়েও মালামাল সরবরাহে ব্যর্থ হয় এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং।
বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির জামানত বাজেয়াপ্তসহ কালো তালিকাভুক্ত করার কথা। কিন্তু ঠিকাদারকে বাঁচাতে ২৪ মে আর্থিক অসঙ্গতি দেখিয়ে রাসিক নিজে থেকেই চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব দেয়। ওই দিনই সম্মতিপত্র নিয়ে ফেরত দেওয়া হয় জামানতের টাকা।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পৌনে ৩ কোটি টাকার চলমান টেন্ডার প্রক্রিয়ায় এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং এর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই প্রতিষ্ঠানটিকে ছাড় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে ওই কাজ ৮০ লাখ টাকা বেশি দরে প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেন টেন্ডার বঞ্চিত কয়েকজন ঠিকাদার। রাসিকের এ সংক্রান্ত কাজের পরামর্শ হিসেবে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাফানুর রহমান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঠিকাদার জানান, যোগসাজশ করে এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে কাজ দিয়েছেন রেয়াজাত হোসেন। প্রতিষ্ঠানটির জমা দেওয়া অভিজ্ঞতার সনদ, ব্যাংক সনদসহ সব কাগজপত্রই ভুয়া। নেই বৈদ্যুতিক ঠিকাদারির লাইসেন্সও। তা সত্ত্বেও বার বার বিধি লঙ্ঘন করে কাজ দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বিপুল অর্থ। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
তবে অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন রেয়াজাত হোসেন। তিনি দাবি করেন, বিধি মেনেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিংকে। তবে কাগজপত্রের ঘাটতি থাকায় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডার কমিটিতে বাতিল হয়েছে। উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পেয়েছে এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং।
নিম্নমানের এলইডি বাল্ব সরবরাহের অভিযোগ অস্বীকার করে রেয়াজাত হোসেন বলেন, তারা যে বাল্ব সরবরাহ করেছে সেগুলো মান পরীক্ষার জন্য রুয়েটের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে পাঠানো হয়েছিলো। সেখান থেকে মানোত্তীর্ণ হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন পাওয়া গেছে।
তবে বাল্বগুলো গুণগত মানের দিক দিয়ে নিম্ন বলে জানিয়েছেন এ সংক্রান্ত গঠিত পরীক্ষণ উপকমিটির প্রধান ও রুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম শেখ।
তিনি বলেন, সরবরাহকৃত বাল্বগুলোর অধিকাংশেরই ওয়াট নির্ধারিত ওয়াটের চেয়ে বেশি। এতে বিদ্যুৎ খরচ বেশি হবে। এ ছাড়া এগুলোর আইপি গ্রেড কম। ফলে এগুলোর পানি নিরোধ ক্ষমতাও কম। এগুলোই তারা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে জিআই পোল সরবরাহে কিছুটা শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন রেয়াজাত হোসেন। তিনি বলেন, স্থাপিত ৯ মিটারের ২৬টি পোল জিআই, যা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তবে ১২ মিটারের ২৮টি উত্তীর্ণ হয়নি। সেগুলো বাদ দিয়েই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তবে ডিপিডিসির সিল মোহরকৃত বৈদ্যুতিক তার ও ফিটিংস সরবরাহের বিষয়টি তার জানা নেই বলে জানান রেয়াজাত হোসেন।
জানতে চাইলে রাজশাহীতে লাগানো ডিপিডিসির সিল মোহরকৃত বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম বিক্রয় বা বিনিময় করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রমিজ উদ্দিন সরকার।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে চোরাই তার ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। এটি খতিয়ে দেখা হবে।প্রমাণ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে নর্থওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাসিকের ওই এলাকার পোল ও লাইন তারা বুঝে পাননি। বুঝে নেওয়ার সময় সেগুলো পরীক্ষা করে নেবেন তারা।
অন্যদিকে বৈদ্যুতিক ঠিকাদারির লাইসেন্স ছাড়াই এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং এর এসব কার্যাদেশ পাবার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ইকেট্রিসিটি লাইসেন্সিং বোর্ডের সচিব প্রকৌশলী আতোয়ার রহমান মোল্লা। তিনি বলেন, বিদ্যমান বিদ্যুৎ বিধিমালায় পরিষ্কার বলা আছে, এবিসি লাইসেন্স ছাড়া এ সমস্ত কাজ করা যাবে না। রাসিক যে সব কাজ করিয়েছে তাতে বিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে দরপত্র কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে এ দায় তাদের নয় বলে জানিয়েছেন রাসিকের দরপত্র কমিটির সদস্য ও রুয়েটের অধ্যাপক ড. এসএম আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, দরপত্রের সমস্ত কাজই করেছে রাসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তারা শুধু সরবরাহকৃত নথির ভিত্তিতে কারিগরি মত দিয়েছেন মাত্র। দরপত্র শর্তে এবিসি লাইসেন্সের ( বৈদ্যুতিক ঠিকাদারি লাইসেন্স) কথা উল্লেখ না থাকায় বিষয়টি রাসিক কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়নি।
এবিসি লাইসেন্স ছাড়া এ সমস্ত কাজ করা যাবে না এটি তাদের জানা ছিলো না বলে দাবি করেছেন রেয়াজাত হোসেন। তিনি জানান, এ নিয়ে ইলেকট্রিসিটি লাইসেন্সিং বোর্ড কখনোই তাদের চিঠি দিয়ে অবগত করেনি। তারা তাদের মত করে শর্ত দিয়ে কাজ করিয়েছেন। এ ছাড়া দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতেও এ শর্ত যোগের বিষয়টি আসেনি। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এমনটি করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তা অস্বীকার করেন রেয়াজাত হোসেন।
এ সব বিষয়ে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এর মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাফানুর রহমানকে। তার দপ্তরের মুঠোফোনে কথা হয় এসএলকে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সেল্স এক্সিকিউটিভ নূর আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, সাফানুর রহমান দেশের বাইরে রয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য নেই বলেও জানান তিনি।