৩ মাস নিখোঁজ থাকার পর অপহরণকারীদের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছেন প্রবাসী বি এন পি নেতা মুজিবর রহমান মুজিব। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে গতকাল দেশের একটি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে একান্তে কথা বলেন প্রবাসী এ নেতা। তিনি জানিয়েছেন কিভাবে তাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের পর তার সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছে। কি জানতে চাওয়া হয়েছে। অপহরণকারীদের বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি। প্রায় সাড়ে তিন মাস নিখোঁজ থাকার পর সোমবার সকালে তাকে গাজীপুর এলাকায় ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। এরপরই তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অপহরণের দিন হঠাৎ পোশাক পরে তৈরি হতে বলা হয় তাকে।ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মুজিব বলেন, 'ভেবেছিলাম আর হয়তো বাঁচবো না। কোথাও নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। এমনটি মনে করে কালেমা পড়ে তৈরি হই। চোখ বাঁধা অবস্থায় হাতের বাঁধন খুলে যখন ছেড়ে দেয় তখনও মনে হয়েছিল আর বুঝি বাঁচবো না। কিন্তু কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারি আমি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছি। আমি জীবন ফিরে পেয়েছি।' কথাগুলো বলছিলেন সাড়ে তিন মাসের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়া বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান।
অপহরণ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, গত ৪ঠা মে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট যাওয়ার পথে টুকেরবাজারে পুলিশ তার গাড়ি থামায়। সড়কে তখন পুলিশের দু’টি গাড়ি। পাঁচজন পুলিশ সদস্য ছিলেন রাস্তায়। পুলিশ চালকের লাইসেন্স দেখতে চায়। লাইসেন্স ভুয়া দাবি করে গাড়িচালক রেজাউল হক সোহেলকে পুলিশ নিয়ে যায়। মুজিবের কাছে তার গাড়ির কাগজ খোঁজে পুলিশ। গাড়ির কাগজ সিলেট নগরীর বাসায় আছে জানালে পুলিশ তাকে বলে, আপনাকে গাড়িসহ থানায় নিয়ে যাবো। পরে বাসা থেকে কেউ কাগজ নিয়ে গেলে পুলিশ ড্রাইভার দিয়ে গাড়িসহ তাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। এসব কথা বলেই দু’জন পুলিশ তার গাড়িতে ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটে এ ঘটনা। গাড়ির পেছনে বসা ছিলেন মুজিব। পুলিশের একজন ড্রাইভিং সিটে অন্যজন ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে। গাড়িতে উঠেই পাশের জন বলেন, গন্ধ লাগছে। এয়ার ফ্রেশনার দাও। অন্য পুলিশ সদস্য পেছনের দিকে মুজিবকে লক্ষ্য করে কিছু একটা সেপ্র করেন। ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি অচেতন হয়ে যান। তিনি বলেন, কর্মসূচি শেষে ফেরায় ঘুম ঘুম ভাব ছিল তাই পুলিশের সঙ্গে কোন তর্কে জড়াননি তিনি।
মুজিব বলেন, অপহৃত হওয়ার পর যখন জ্ঞান ফিরে তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন হাতে হ্যান্ডকাফ, পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায়। মেঝেতে পড়ে আছেন। টের পান পুরো শরীরে ব্যথা। শব্দ করে জানতে চান তার অবস্থান। সঙ্গে সঙ্গে পাশে থেকে ধমকের সুরে বলা হয়, শাটআপ বাস্টার্ড, উই উইল কিল ইউ...! চিৎকার করবি না- বলেই মুজিবকে সজোরে লাথি মারে একজন। কখন দিন কখন রাত তা টের পাওয়া ছিল দুস্কর। তবে জ্ঞান ফেরার প্রায় আট ঘণ্টা পর তিনি ফজরের আজান শুনেছেন। ওই সময়ে তাকে খাওয়ার জন্য কলা রুটি দেয়া হয়। সেখানে একাধিকবার পানি খাওয়ার পর অচেতন হয়েছেন তিনি। তার ধারণা পানির মধ্যে ওষুধ মিশিয়ে দেয়া হতো। বন্দি থাকা অবস্থায় তিন বার স্থান পরিবর্তন করা হয়। প্রথমবার ২০ থেকে ২৫ মিনিট গাড়ি চালিয়ে নতুন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। স্থান পরিবর্তনের সময় তাকে কাঁধে করে গাড়িতে তোলা হতো। স্থান পরিবর্তন হচ্ছে- এইটুকু টের পেয়েছেন।
সর্বশেষ মুক্ত হওয়ার পাঁচ-সাত দিন আগে স্থান পরিবর্তন করা হয়। প্রথম দিকে ভাত খেতে না পারলেও পরে ভাত খেতেন মুজিব। আলু ও বেগুন ভর্তা এবং গরু ও খাসির মাংস খেতে দেয়া হতো তাকে। খাওয়ার সময়ও তার চোখ বাঁধা থাকতো। হ্যান্ডকাফ হাতে নিয়েই খেতে হতো। অপহরণকারীদের একজন প্লেট মুখের কাছে তুলে ধরতো। বন্দি অবস্থায় ১০ থেকে ১২ দিন পর পর গোসল করানো হতো তাকে। রমজানে তাকে যেখানে রাখা হয় সেখানে সেহরির সময় মসজিদের মাইক থেকে ঘুম ভাঙানোর জন্য ডাকা হতো। একাধিক মসজিদের আজানের শব্দ কানে আসতো। প্রায়ই রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচির মাইকের আওয়াজ পেতেন তিনি। ঘুমানোর জন্য ফ্লোরে একটি বালিশ দেয়া হতো তাকে। অপহরণের পর তার মোবাইলফোন, ঘড়ি ও মানিব্যাগ আর খুঁজে পাননি তিনি। মুজিবের পাহারায় সবসময় অপহরণকারী দলের চার-পাঁচ জন থাকতো।
অপহরণের পর মারধর করা হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপহরণের প্রথম দিকে বেশি মারধর করা হয়েছে তাকে। জ্ঞান ফিরলেই লাঠি দিয়ে প্রহার করে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হতো। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বিএনপি নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে তারা তথ্য চাইতো। যুক্তরাজ্য থেকে কি পরিকল্পনা হচ্ছে- এ সম্পর্কে জানতে চাইতো। মুজিব তখন তাদের বলেছেন, তারা সিনিয়র নেতা। আমি তাদের সম্পর্কে কিছু জানি না। তখন আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতো তারা। শরীরে বিভিন্ন স্থানে, হাড়ের জোড়ায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতো। লাঠির আঘাতে কালো হয়ে গেছে তার শরীরের বিভিন্ন স্থান। এছাড়া বিভিন্ন কাগজ এনে এতে সই নিয়েছে তারা। তাকে ছেড়ে দেয়ার কিছুদিন পূর্ব থেকে টাকা দাবি করতো অপহরণকারীরা। কখনও ১০ কখনও ১২ কখনওবা ১৫ কোটি টাকা ছিল তাদের দাবি। মুজিব বলতেন, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি টাকা দেবো। না ছাড়লে টাকা দেবো কি করে। তবে মুজিবের কাছে মনে হয়েছে টাকার দাবিটা জোরালো ছিল না। তিনি বলেন, টয়লেট এবং গোসল করার সময়ও চোখের বাঁধন খোলা হতো না। এ অবস্থায় অপহরণকারী যে কোন একজনকে ধরে বাথরুমে যেতেন তিনি। তার হাতের ছোঁয়ায় মনে হয়েছে অপহরণকারীদের চুল খুব ছোট করে ছাঁটা। তারা লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তারা সব সময় ইংরেজি ও শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতো। তারা নিজেদের কাউকে স্যার বলে সম্বোধন করতো।
ফিরে আসার দিনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত সোমবার সকালে আন্ডারওয়ার পরতে বলা হয়। পোশাক পরতে বলা হয়। মুজিব জানান, তখন মনে হয়েছে আজ মেরে ফেলা হবে। হয়তো ‘ক্রসফায়ার’ করা হবে। তার মুখে তখন ট্যাপ লাগানো হয়। চোখ বাঁধা অবস্থাতেই তাকে বোরকা পরানো হয়। অপহরণকারীরা তাকে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে নামায়। পরে গাড়িতে তুলে প্রায় এক ঘণ্টা ঘুরে গাজীপুর এলাকায় ফেলে রেখে যায়। মুজিব মনে করেন ইচ্ছা করেই তাকে ভুল ধারণা দেয়ার জন্য গাড়িতে করে এক ঘণ্টা ঘোরানোর পর ছেড়ে দেয়া হয়। ছেড়ে দেয়ার সময় শুধু হাত থেকে হ্যান্ডকাফ খুলে নিয়ে যায় তারা। তাৎক্ষণিকভাবে চোখ খুলে পাশেই তার গাড়িচালক সোহেলকে দেখতে পান একই অবস্থায়। দু’জনে বোরকা খুলে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে টঙ্গীতে পৌঁছান। সেখান থেকে অটোরিকশা নিয়ে গুলশানের বাসায় যান মুজিবুর রহমান মুজিব। পথিমধ্যে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারের সামনে নেমে যান গাড়িচালক সোহেল। এ সময় সোহেলকে এক হাজার টাকা দেন মুজিব। তবে অপহৃত অবস্থায় চালকের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। ছাড়া পাওয়ার পর প্যান্টের পকেটে ৫৫০০ টাকা পান তিনি। অপহরণকারীরাই তাকে ছেড়ে দেয়ার আগে এই টাকা দেয়। উদ্ধারের পর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে মুজিবুর রহমান মুজিবকে। তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিনি এখনও দুর্বল, তার শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। অপহরণকারীরা নির্যাতন করায় তার শরীরে, হাতে-পায়ে দাগ রয়েছে।
এতো কিছুর পরে নিজের জীবন ফিরে পেয়ে আনন্দিত মুজিব।যেখানে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না সেখানে অনেকটা ভালোভাবেই ফিরে আস্তে পেরেছেন তিনি।তবে ভয় যেন এখনো তাড়া করে ফিরছে তাকে।